সমকামিতা কি অপরাধ?

Share

আমাদের সমাজের সকলেই মনে করেন সমকামিতা একটি ঘৃণিত কাজ, আমাদের রাষ্ট্র তো সমকামিতাকে অপরাধ-ই বানিয়ে ফেলেছেন এবং এর জন্য শাস্তির বিধান করেছেন। অথচ আদিকাল থেকেই তো আমরা দেখে আসছি শিল্প-সাহিত্যেও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত এই অভিলাষের প্রতিফলন।

গ্রিক সভ্যতা থেকে প্রাচীন ভারত। সমকামিতার উদাহরণ যুগে যুগে। আধুনিক সাহিত্য-সিনেমাতেও বারবার জায়গা করে নিয়েছে সমকামী মানুষের গল্প। প্রাচীন নাগরিক সমাজ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা যেখানে জন্ম নিয়েছিল গ্রিসে। সেই গ্রিস, যে কখনও নাগরিকের যৌন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। সমলিঙ্গ যৌন সংসর্গের বৈধতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না সেখানে। হেরোডেটাস, প্লেটোর মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদদের লেখায় আকছার পাওয়া যায় সমকামী সম্পর্কের কথা।

আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিসের লেসবস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্যাফো। এই মহিলা কবির লেখার প্রতিটি পরতে পরতে নারী শরীরের বন্দনা। স্যাফোর জন্মস্থান লেসবস থেকেই তো অভিধানে জায়গা পেয়েছে লেসবিয়ান শব্দটি।

পাশ্চাত্য থেকে এবার আসা যাক প্রাচ্যে। ইতিহাস বলছে, প্রাচীন পারস্যে সমকামী সম্পর্কের চল ছিল। যেমনটা ছিল, এই ভারতবর্ষেও। বহু হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্য তো সমকামেরই অভিজ্ঞান। খাজুরাহোর শিল্পকীর্তিতে তো রয়েছে গ্রুপ সেক্সের নিদর্শনও। মহাভারতে বৃহন্নলা আর শিখণ্ডি, পুরাণে বিষ্ণুর মোহিনী রূপ আর অর্ধনারীশ্বর শিব, মহাকাব্য- পুরাণের পাতায় পাতায় যেন তৃতীয় লিঙ্গের সদর্প উপস্থিতি। এমনকী, বাতসায়নের কামসূত্রও বলছে সমকামিতা যৌন সম্পর্কেরই অন্য রূপ।

আধুনিক সাহিত্যেও বহু লেখকের কলমে স্বীকৃতি পেয়েছে সমকামিতা। প্যারিসের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে যে মানুষটি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের যৌনসত্ত্বা, তাঁর কথা জেমস বল্ডউইন লিখে গেছেন জিওভান্নিজ রুম বইয়ে। ই এম ফস্টারের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় মাউরাইস। ব্রিটেনে যখন সমকামিতা নিষিদ্ধ ছিল, তখন দুই পুরুষের প্রেমের গল্প যার উপাখ্যান। অস্কার ওয়াইল্ডের জীবনী লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত এই সমকামী সাহিত্যিকের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন রিচার্ড এলম্যান।

দীপা মেহতার ফায়ার বা মধুর ভাণ্ডারকারের পেজ থ্রি। সমকালে ভারতীয় সিনেমাতেও সমলিঙ্গ প্রেমের হরেক উদাহরণ। সদ্যপ্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রাঙ্গদা, কিংবা তিনকন্যা, তাসের দেশের মতো হাল আমলের নানা বাংলা ছবির গল্পও ঘিরেছে সমকামী সম্পর্ক।

ইতিহাস বর্তমান, কোনও কালেই সমকামিতাকে অস্বীকার করার উপায় না থাকলেও রক্ষণশীল সমাজের বাধা আছেই। অস্বাভাবিকতার দোহাই দিয়ে বারবার দমিয়ে দেওযার চেষ্টা হয়েছে মানবের ইচ্ছেকে। অথচ কী আশ্চর্য, সেই আদিকাল থেকেই তো মানবমনের গোপন ঠিকানার হদিশ করতে করতেই তো এগিয়েছে আমাদেরে শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা।