অদৃশ্য নির্যাতিত মাইনরিটির মত বেঁচে থাকতে আর ভালো লাগেনা

Share

আমি আবদুল্লাহ আল হাসান। একজন সমকামী। এই কথাটি প্রকাশ্যে বলতে আমাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং আমার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে আমাকে দুঃখজনক ভাবে কথা বলতে হচ্ছে। গতকাল এক পাবে গিয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে ড্রিংক করতে। মূলত ইস্ট লন্ডন কেন্দ্রিক পাব হওয়াতে প্রচুর বাংলাদেশী ছিলো। আমার পরিচিত এক বন্ধু (বহু আগে লন্ডনে আসার পর পরিচিত হয়েছিলাম) আমাকে দেখেই সামনে এগিয়ে এলো। তার সাথে আরেকটি ছেলে।

বন্ধুর সাথে দেখা হবার পর পাশের ছেলেটির সাথেও পরিচিত হলাম। কিন্তু আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমার সেই বন্ধুটি তার সাথের যে ছেলেটিকে যে কথা বল্লো সেটির জন্য অন্তত এখানে প্রস্তুত ছিলাম না। অনেকটা মজা করে সে হাসতে হাসতে বল্লো, “বদ্দা চিটিগাইঙ্গা যে, পোয়া লাগায়”। মানে দাঁড়াচ্ছে, আমি চট্টগ্রামের এবং আমি ছেলেদের সাথে যৌন সম্পর্ক করি।

আমার এই বন্ধুটি জানে আমি সমকামী। এটা তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের জের ধরে হয়েছে। কিন্তু এইভাবে ভরা মজলিশে এতগুলো মানুষের সামনে এইভাবে গা দুলিয়ে নোংরা ভাবে আমার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টশন যে আসলে ঠিক এইভাবে বলা যায় এটা কখনো ভাবিনি। আমি খুব আহত দৃষ্টিতে আমার সে বন্ধুর দিকে তাকাতেই, তিনি আবার বললেন , “দোস্তো মাইন্ড করলা নাকি?”।

আমি আর কথা বাড়াই নি। ইগনোর করে আমার অন্য বন্ধুদের সাথে মিশে গেলাম।

বাংলাদেশে সমকামিতা একটা ভয়ানক ব্যাপার। এটি যেমন সামাজিক ভাবে সত্য ঠিক একইভাবে রাষ্ট্র-ও এই ব্যাপারটাকে আইনীভাবে মোকাবেলা করেছে আইন দিয়ে। বাংলাদেশের পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারামতে একজন সমকামি ব্যাক্তির যৌন্তার ফলে তাঁর ১০ বছররের জেল ও অর্থদন্ড পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে যদিও এই ধারায় এই পুরো ব্যাপারটিকে কায়দা করে অপ্রাকৃতিক যৌনতা নিষিদ্ধের কথা বলা রয়েছে। এই অপ্রাকৃত্রিক যৌনতা কথাটির মানে রাষ্ট্র-ই করে দিয়েছে যে সাধারণ নারী ও পুরুষের যে যৌনতা তার বাইরে অন্য যে কোন সম্পর্কের ব্যাপারটাই নিষিদ্ধ। মানে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্র তার জনতার উপরে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে।

আমাদের দেশের সংবিধানে সকল প্রকার বৈষম্যহীন উল্লেখিত অধিকার সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হলেও বাস্তবে আমারা তার প্রতিফলন দেখি না। বিশেষত যৌন প্রবৃত্তিগত সংখ্যালঘু ব্যক্তি সর্বদা পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র,শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রসহ সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হয়। এমন কি দেশের প্রচলিত আইন দ্বারাও তাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। দেশে প্রচলিত আইনে দুজন পুরুষ ও মহিলা ইচ্ছার বিরুদ্ধে,সম্মতি ব্যতীত,ভয় দেখিয়ে বা প্রলোভনের দ্বারা সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে অথবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন মহিলাকে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতীত যৌন সহবাস করে তবে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গন্য হয়। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন পুরুষ ও মহিলা কোন প্রকার প্রলোভন ও ভয়ভীতি ছাড়া স্বেচ্ছায় জনসম্মুখের অগোচরে বেশ্যাবৃত্তির উদ্দেশ্য ব্যতীত যৌন সহবাস করে তবে তা অপরাধ নয় অথচ যদি পূর্ণ সম্মতিতে কোন প্রকার প্রলোভন ও ভয়ভীতি ব্যতীত দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ নিজেদের সাথে যৌনসহবাস করে;বা দু’জন মহিলা নিজেদের সাথে যৌনসহবাস করে;বা একজন পুরুষ একজন মহিলার সাথে ভ্যাজাইনাল যৌনসহবাস ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে যৌনসহবাস করে,তবে তা আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অথচ সমকামিতার পুরো ব্যাপারটা কিন্তু প্রাকৃতিক। একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা সভ্য দেশে ঠিক কিভাবে কার সাথে কে যৌন সম্পর্ক করবে সেটি সুনির্দিষ্ট করে জানিয়ে দেয়া যায় এটা আমার জানা নেই অথচ বাংলাদেশে এটা রয়েছে ও তার জন্য শাস্তির বিধানও উপরে বলেছি।

ওই যে উপরে বন্ধুর কথা বর্ণিত করেছি সেখানে নানাবিধ ব্যাপারো চলে আসে। যেমম আমি চট্রগ্রামের তাই আমি ছেলেদের সাথে যৌনতা করব, এটি আমার সে বন্ধুটি ধরেই নিয়েছে যদিও আমার ক্ষেত্রে সত্য কারন আমি ছেলেদের প্রতি যৌনভাবে আকৃষ্ট। মেয়েদের প্রতি নই। আমার এটা হয়না। আসেনা। আমি কি করতে পারি? আমি কিভাবে জড় করে একটা মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হব, আমার জানা নেই।

বাংলাদেশে এমন অনেক কিছু চালু রয়েছে। যেমন নোয়াখালীর লোক খেয়েই নাকি বাসায় চলে যায় (যদিও এই ইহ জীবনে আমি এর সত্যতা পাইনি), বরিশালের লোক খারাপ, সিলেটের লোক খুব বেশী উগ্র জাতীয়তাবাদী, কুমিল্লাতে সব মানুষ ইতর, নর্থ বেঙ্গলের মানুষ কিপটে ইত্যাদি। এই যে এইসব চালু কথন বা মিথ, এগুলো কিন্তু এক রকমের বর্ণবাদী আচরণ, সাম্প্রদায়িক আচরণ।

বাংলাদেশের সামাজিকতাগুলো আমার বন্ধু এই লন্ডনে আমদানী করেছে এবং একজন অসভ্য মানুষের মত সকলের সামনে আমাকে আমার যৌনতার গোত্র বিবেচনা করে সে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, মশকরা করেছে অথচ এই একই লোক কিন্তু একজন স্ট্রেট ছেলের ক্ষেত্রে এইভাবে বলতো না। মানে আমি যদি স্ট্রেট হতাম সে কিন্তু কখোনই বলতো না, “এই যে এই ছেলেটি কিন্তু একজন নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক করে…”। কেবলমাত্র আমার যৌন পছন্দের উপর ভর করে আমাকে যেভাবে সিঙ্গেল আউট করা হচ্ছে বা হয়েছে সেটি আমাকে শুনে আসতে হয়েছে সারাটি জীবন।

চট্রগ্রামের রাউজানের ছেলে আমি। আমাকে সব সময় যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদেরের এলাকার ছেলে, এই কথাটি শুনতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে আমি ছেলে লাগাই (মানে ছেলেদের সাথে সেক্স করি), শুনতে হয়েছে আমি চট্টগ্রামের লোক, আমি ঝাল বেশী খাই, শুনতে হয়েছে আমি চট্রগ্রামের লোক সুতরাং আমার কথা নাকি বুঝতে পারা যায় না ইত্যাদি।

এইভাবে বিভাগওয়ারী একটা সুনির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রতিনয়ত শুনতে হয় যদিও আমি সমকামী কিন্তু আমার মত সকল ছেলে তো নয়!! আর সমকামী হয়েছি বলে সেটা কি অপরাধ? আমি কি প্র্যাক্টিস করে করে কিংবা ইচ্ছা করে সমকামী হয়েছি? আমি কি আমার জিনের গঠন তৈরী হবার সময় আমার জিনের বৈশিষ্ট্য নিজে নিজে তৈরী করেছি? আমার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের উপর আদৌ কি আমার হাত আছে? আমি কি একজন অপরাধী?

আমি এই লন্ডনে বাঙালী কোন পরিবেশে যেতে পারিনা। এখানে আমাকে দেখলেই আড়ালে আবডালে শুনতে পাই বলা হচ্ছে মাইজ্ঞা, পোয়াখোর, চুতিয়া, ব্রাদারফাকার ইত্যাদি। আমার এই কষ্টগুলো নিয়ে যে কারো সাথে কথা বলব সে উপায়টিও নেই। কার সাথে কথা বলব? কে শুনবে আমার কথা কিংবা আমার মত প্রতিদিন এবিউজ হওয়া ছেলেদের কথা? কেউ তো নেই।

এমনও হয়েছে আমি সমকামী বলে আমার খাওয়া গ্লাসে পানি খায়নি অনেকে, আমার খাওয়া প্লেটে আমার ভাই খাওয়া প্রত্যাখান করেছিলো। কি ভয়াবহ সময়গুলো আমি পার করেছিলাম এবং আজও করছি। এই সমকামিতার ট্যাবু যে শুধু বাংলাদেশে রয়েছে তা কিন্তু নয়। এই খোদ ইংল্যান্ডেও এই সম্পর্ককে ভালোভাবে দেখা হয়না। যদিও এটি সভ্য দেশ। টলারেন্স অনেক বেশী। সহজ চোখে আমাদের মত সমকামীদের উপর সামাজিক বিদ্বেষগুলো বুঝতে পারা যায় না কিন্তু একটু সুক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ করলেই দেখা যায় এখানেও একজন সমকামীকে নিয়ে বুলি করা হয়, আড়ালে কথা বলা হয়, আড়ালে ইয়ার্কি-ফাজলামী কিংবা তাঁকে নিয়ে মজা করা হয়, গসিপ করা হয়। মানে দাঁড়াচ্ছে, সমকামী হবার ফলে এই সারা পৃথিবীতে একটা অলিখিত মাইনোরিটির মত বেঁচে রয়েছি। এই দুঃখ ও কষ্ট কোথায় রাখব আমি জানিনা।

এইতো কয়দিন আগেই শুনেছি বাংলাদেশে সমকামী সন্দেহে কেরাণীগঞ্জে ২৭ জন ছেলেকে ধরে পেটানো হয়েছে, এবিউজ করা হয়েছে। মানে দেশে এখন সমকামী হবার আর দরকার নেই, কেবল প্রমাণ পেলেই হোলো। কি ভয়াবহ অবস্থা, কল্পনা করা যায়?

প্রশ্ন এসেই যায় যে আমাদের করণীয় কি? আমরা কি মরে যাব? আমরা কি সারাটিজীবন এই পৃথিবীর মানুষগুলো থেকে লুকিয়ে থাকব? আমি তো প্রাকৃতিকভাবে আমার এই যৌন ধারার থেকে বের হতে পারব না। এটি যদি প্র্যাক্টিস করে করে শেষ করা যেতো তা না হয় একটা কথা ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটি তো আসলে এমন নয়। আমি হাজার কিংবা লক্ষবার চেষ্টা করেও তো আমার সেক্সুয়াল এই ধারাটি থেকে বের হতে পারব না। আমার এই যৌন পছন্দের কারনে আমাকে বাবা-মা অভিশপ্ত মনে করেন, ভাইরা মনে করেন, আত্নীয়রা মনে করেন, বন্ধুরা মনে করেন। যেই লন্ডনে দু দন্ড শান্তি পাবো বলে ভেবেছি এখানেও আড়ালে মানুষ হাসে। তবে যাবো কোথায়?

প্রতিটি ধর্ম গ্রন্থেই তো আমাদের অভিশপ্ত বলা হয়েছে। সেখানেও আমাদের স্থান নেই। আইন দিয়ে শাস্তি নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। শুধু যে বাংলাদেশে এই অবস্থা তা কিন্তু নয়। আমেরিকাতেও সমকামিতা বাজে ভাবে দেখা হয়, মধ্য প্রাচ্যের কথা আর নাইবা বললাম, ভারতে, দক্ষিন আমেরিকায়, গণচীনে সবখানেই আমাদের বেহাল অবস্থা।

আমাদের এই অবস্থা নিয়ে, এমন সমকামীতা হবার কারনগুলো কিংবা সমকামিতার বিরুদ্ধে সামাজিক ট্যাবুগুলো ভাঙ্গতে দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, কেউই-তো এগিয়ে আসেন না। জোর গলায় এটি নিয়ে কথা বলেন না। এক অভিজিতদা লিখেছিলেন, তাঁকে তো কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো। জুলহাজ মান্নান ভাই, মাহবুব তনয় ভাই এই দুইজনকেও খুন হতে হয়েছিলো শুধু মাত্র সমকামী হবার অপরাধে।

প্রায়ই মনে হয় আত্নহত্যা করি। একা একা নিজের ঘরে নিজেই ম’রে যাই। বাবা নেই, মা নেই, দেশ নেই, বন্ধু নেই, ভাই নেই, স্বজন নেই। আমরা কারোর নই, কেউ আমাদের নয়।

একটা অদৃশ্য নির্যাতিত মাইনরিটির মত বেঁচে থাকতে আর ভালো লাগেনা। আর ভালো লাগেনা এমন জীবন।