সমকামিতা কি একটি মানসিক বিকৃতি?
Share
আমাদের সমাজে একটি কথা খুব করে প্রচলিত আছে, সমকামিতা নাকি এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। কেউ এই বিষয়ে ভালোভাবে না জেনেই এরূপ মন্তব্য করে বসে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়, আমাদের বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষগুলো এধরনের মন্তব্য করে থাকেন।
তবে আমি বলবো না, একেবারেই না। সমকামিতা কোনভাবেই মানসিক বিকৃতি নয়, বরং অন্য দশজন মানুষের মতো এটাও একটি প্রাকৃতিক বিষয়। কেউ ইচ্ছে করলেই সমকামী হয়ে যেতে পারেনা। সমকামীরা জন্মগতভাবেই সমকামী।
মেডিক্যাল সায়েন্স অনুযায়ী ১৯৯৩ সালের আগে সমকামিতাকে মনে করা হতো একটা মানসিক রোগ। কিন্তু এ বিষয়ে গভীর গবেষণায় দেখা গেছে, সমকামিতা আসলে কোন মানসিক রোগ নয়, এটি মানসিক রোগের কোন শর্ত পূরণ করে না। সমকামীরা অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই, কোন পার্থক্য নেই। তারা সামাজিক বা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কাজে সমান পারদর্শী। প্রকৃতপক্ষে তাদের মন মানসিকতা অনেক উদার হয়, অনেক নরম, অন্যের প্রতি মায়া মমতায় ভরা। এবং ঠিক এ কারণেই, ১৯৯৩ সালে মনোরোগের পাঠ্য বই থেকে সমকামিতাকে রোগ তুলে নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর সকল মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মিলে এদের বিরুদ্ধে কোন বৈষম্য করাকে বেআইনি বা অন্যায় বলে মতামত দেন।
খুব সাধারণভাবে সবার জন্যে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বেশিরভাগ রোগ, বিশেষ করে ক্রনিক রোগগুলোর জন্যে বহুবিধ কারণ দায়ী। এটাকে বলা হয় মাল্টি ফ্যাক্টোরিয়াল মডেল। যেমন ধরুন স্তনের ক্যান্সার। কারো স্তন ক্যান্সারের বংশগত জিন শরীরে থাকে, কিন্তু তা থাকলেই যে রোগ হবে, এমন কথা নেই। হয়তো খাদ্যাভ্যাস, বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, বয়স ইত্যাদি অন্যান্য ফ্যাক্টর বা উপাদান মিলিয়ে একজনের স্তন ক্যান্সার হয়। ডায়াবেটিসও তাই। শরীরে জিন থাকে কিন্তু তারপরও খাবারের অভ্যাস, ব্যায়াম না করা, এমন কি কী পরিবেশে বড় হলো – সব মিলিয়ে তার রোগটি হবে।
সমকামিতার ব্যাপারটাও তাই। আগে ডাক্তার, বিজ্ঞানী কেউ বুঝতে পারে নি যে, এটা কোন রোগ না। মানসিক রোগের কোন শর্তও এটা পূরণ করে না। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ, যাদের আমরা প্রতিদিন দেখি, তারা সমকামী, কিন্তু সামাজিক, নৈতিক, প্রফেশনাল দিক থেকে এরা অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মতোই। বিজ্ঞানে যা এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা হলোঃ এদের শরীরে একটি বিশেষ জিন (জিনেটিক প্যাটার্ন) থাকে যা বিষমকামীদের থাকে না। কিংবা, পৃথিবীর কেউ-ই ১০০ ভাগ সমকামী বা ১০০ ভাগ বিষমকামী হয়ে জন্মায় না। এদের মস্তিস্কের নিউরনের নিউরোট্রান্সমিটার, হরমোন এগুলোও কিছুটা ভিন্ন। অন্য আরেকটি ফ্যাক্টর হলো ‘এপিজিনেটিক’ যা পরিবেশ এমন কি বাবা-মার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেও যুক্ত।
তাহলে একজন সমকামী হবার পেছনে অনেক কারণ যুক্ত যার অনেকগুলোই নিজেদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে। এসব জানার পরে কেন আমরা তাদের ঘৃণা করবো? শুধু ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে এ ছাড়া আর কোন যুক্তি নেই। অন্যান্য যুক্তিগুলো আমার নোটে দিচ্ছি। কারো ডায়াবেটিস হলে তাকে কি আমরা ঘৃণা করি? করি না। অন্যদিকে কেউ প্রেগন্যান্ট হলে বলি “অমুকে অসুস্থ”। আসলে প্রেগন্যন্সি কোন অসুস্থতা না। তেমনি কেউ যদি প্রকৃতিগতভাবে আলাদা হয়, তার জন্যে কোন ঘৃণা তার প্রাপ্য নয়।